সমস্ত লেখাগুলি

নভেম্বর বিপ্লব – জন রীড-এর চোখে -
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Nov. 25, 2024 | সমাজ | views:898 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সেপ্টেম্বর ১৯১৭। ফিনল্যান্ড-এ আত্মগোপন করে থাকার সময়ে লেনিন একটি বই লিখতে শুরু করেছিলেন। তার নাম রাষ্ট্র ও বিপ্লব। ছটি পরিচ্ছেদ লেখা শেষ হয়েছিল। সপ্তম পরিচ্ছেদ লেখা সবে শুরু হয়েছে এমন সময়ে, লেনিন বলছেন, 

“ ‘ব্যাঘাত’ ঘটাল রাজনৈতিক সংকট, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বাহ্ন। এমন ‘ব্যাঘাতে’ কেবল আনন্দই হবার কথা। তবে পুস্তিকার দ্বিতীয় অংশটা (‘১৯০৫ ও ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা’ নিয়ে) হয়ত দীর্ঘকাল স্থগিত রাখতে হবে। লেখার চেয়ে বিপ্লবের অভিজ্ঞতা লাভ করাই বেশি প্রীতিকর ও হিতকর।” (পেত্রগ্রাদ, ৩০ নভেম্বর ১৯১৭)


যে-অভিজ্ঞতা লেনিন অর্জন করেছিলেন সেটি প্রত্যক্ষভাবে এক বিপ্লবীর। কিন্তু বিপ্লব নিয়ে লিখে চলেছিলেন এক তরুণ মার্কিন সাংবাদিক, জন রীড (১৮৮৭-১৯২০)। তারই পরিণামে ১৯১৯-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরল তাঁর বই, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। তার মুখবন্ধ (ইনট্রোডাকশন) লিখে দিলেন নিকোলাই লেনিন (ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ)। আর পাতারও কম জায়গায় লেনিন বইটির সুখ্যাতি করলেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কারণে। বিপ্লবের প্রথম দশ দিনের রোমাঞ্চকর সব ঘটনার বিবরণ বইটিতে পাওয়া যাবে—সুখ্যাতি সেই কারণে নয়; প্রলেতারীয় বিপ্লব আর প্রলেতারীয় একনায়কত্ব বলতে ঠিক কী বোঝায়—এই সমস্যাই বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের মূল সমস্যা। রীড-এর বইটি পড়লে এই দুটি ব্যাপারে পাঠকের ধারণা পরিষ্কার হবে—এই কারণেই লেনিন সুপারিশ করেছিলেন বইটি কোটি কোটি কপি ছাপা হোক আর সব ভাষায় তর্জমা হোক।

সুখের কথা, আরও অনেক ভাষার মতো বাঙলাতেও রীড-এর বইটির তর্জমা হয়েছে, যদিও অনেক দেরিতে। প্রথম বাংলা সংস্করণ বেরিয়েছিল মস্কো থেকে, ১৯৬৭-তে। ঘটো বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে আরও অনেক কারণে স্মরণীয়। ১৯৭০-এ তার দ্বিতীয় সংস্করণ বেরয়, ১৯৭৭-এ তৃতীয় আর ১৯৮৭-তে চতুর্থ (সম্ভবত শেষ) সংস্করণ।


সবচেয়ে বড় কথা বইটির শেষে প্রকাশকের উপসংহার ও আলবার্ট উইলিয়মস-এর লেখা জন রীড এর সংক্ষিপ্ত জীবনী মস্কো সংস্করণটিকে পাঠকদের পক্ষে আরও উপযোগী করেছিল।


দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন-এর ভূমিকায় (নিউ ইয়র্ক, ১ জানুয়ারি ১৯১৯) রীড লিখেছিলেন –


“বইটি হল ঘনীভূত ইতিহাসের একটা অনুচ্ছেদ, —সে ইতিহাসকে আমি যেটুকু দেখেছি।... পর পর কয়েকটি বই আমি লিখছি, তার প্রথম পুস্তক হিসেবে এই বইটিতে আমি শুধু নিজের দেখা ঘটনা ও অভিজ্ঞতা কিংবা প্রমাণসিদ্ধ তথ্যের বিবরণে সীমাবদ্ধ থাকব।”

ভূমিকাটি শেষ হয়েছিল এই বলে –

“এ সংগ্রামে আমার মনোভাব নিরপেক্ষ ছিল না। কিন্তু মহান এই দিনগুলোর কাহিনী বলার সময়ে আমি সত্যকথনে আগ্রহী। একজন বিবেকবান রিপোর্টারের চোখ দিয়েই ঘটনাগুলোকে দেখার চেষ্টা করেছি।”


রীড-এর বইটি বেরনোর পর রুশ বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে বহু ভাষায় বহু বই লেখা হয়েছে। মহাফেজখানার নথি, পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলির খবরের কাগজের সম্পাদকীয় মন্তব্য ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে – বিপ্লব কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বিপ্লব যে সত্যিই কোনো ভোজসভা নয়; বাধ্য হয়েই এমন অনেক কিছু করতে হয় যেগুলি কারুরই কাম্য নয়। রীড-এর বই-এ তারও কিছু নমুনা আছে। প্রতিবিপ্লবী শক্তি কীভাবে ও কত উপায়ে বিপ্লবকে বান্‌চাল করার উদ্যোগ নিয়েছিল তার বিশদ বিবরণ আছে ভিক্টর সার্জ (১৮৯০-১৯৪৭)-এর ফরাসিতে লেখা রুশ বিপ্লবের প্রথম বছর  (১৯৩০) বইটিতে। এমন কোনো কু-মতলব, ফিকিরফন্দি আর চোরাগোপ্তা পদ্ধতি নেই, যা প্রতিবিপ্লবীরা কাজে লাগায়নি।


রাশিয়ার মাটিতে লাল ঝান্ডা প্রথম তুলেছিলেন এক তরুণ ছাত্র, গিওর্গি প্লেখানভ। উপলক্ষ্য ছিল সেন্ট পিটার্সবুর্গ-এ শ্রমিকদের প্রথম সমাজবাদী বিক্ষোভ মিছিল (৬ ডিসেম্বর ১৮৭৬)। তখনও রাশিয়ার কোনো সমাজবাদী-গণতান্ত্রিক সংগঠন ছিল না। প্লেখানভ-ই প্রবাসে মার্কসীয় প্রবণতার প্রথম রুশ বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে তোলেন (সুইট্‌সারল্যান্ড ১৮৮৩)। সেই প্লেখানভ, যাঁর লেখা পড়ে এক প্রজন্মর রুশ তরুণ মার্কসবাদ শিখেছিলেন, পরে মেনশেভিকদের নেতা হন, বিশ বছরেরও বেশি বলশেভিকদের সঙ্গে তাদের উত্তর চলে। অক্টোবর ১৯১৭-র তিনি রাশিয়াতেই ছিলেন, তবে অসুস্থ, শয্যাশায়ী। জাক সাদুল-কে ১৭ অক্টোবর তিনি বলেন, ‘এই পোকাটাকে [অর্থাৎ বলশেভিকদের] শুধু বশে আনলেই হবে না, টিপে মারতে হবে, রক্তে ডুবিয়ে দিতে হবে। রাশিয়ার নিরাপত্তার ঐ হলো কিম্মত।’ মাকসিম গর্কি-র নবজীবন  পত্রিকায় ডাক দেওয়া হলো – “বলশেভিকদের মানতে অস্বীকার করুক নাগরিকরা, সক্রিয়ভাবে অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করুক, অন্তর্ঘাত ও খাবার সরবরাহে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করুক। তাঁদের রাশিয়ার নাগরিকদের মূল মন্ত্র হলো – বলশেভিকদের বিরুদ্ধে, সব পদ্ধতিই ভালো” (সার্জ, ইয়ার ওয়ান অফ রাশিয়ান রেডলিউশন, শিকাগো – হোল্‌ট, রাইনহার্ট অ্যান্ড উইনস্টন, ১৯৭২, পৃ. ৯২-এ উদ্ধৃত)।


কোন্‌টি ক্রিয়া আর কোন্‌টি প্রতিক্রিয়া তা না বুঝলে রুশ বিপ্লবের আসল চেহারা ধরা যাবে না। গোটা রাশিয়া নয়। পেত্রগান ও তার আশেপাশের ঘটনা নিয়ে রীড-এর প্রাণবন্ত বিবরণ নভেম্বর বিপ্লব-এর ইতিহাস পড়ার ক্ষেত্রে প্রবেশকের কাজ করবে। দশটি মাত্র দিনের ঘটনাবলি যেন ইতিহাসের নির্যাস। কত বাধা (ভেতরের ও বাইরের), কত চক্রান্ত, কত বেইমানি পেরিয়ে বিপ্লব সফল হয়েছিল—এই বইটির মধ্যেই তার যথাযথ ছবি ধরা আছে। আর সেই কারণেই এ বই-এর মর্যাদা কখনও কমবে না।


এখন বাজারে মূল বইটির একটি সংস্করণ সহজেই পাওয়া যায়। সেটি বার করেছে পেঙ্গুইন বুক্‌স্‌। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এ জে পি টেলর-এর ভূমিকা সমেত এটি বেরিয়েছিল ১৯৭৭-এ; এখনও সেই সংস্করণটিই কিনতে পাওয়া যায়। ভূমিকায় অধ্যাপক টেলর-ও কিছু কিছু তথ্যগত ভুলের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু গুটিয়ে প্রতিটি ঘটনা ও ব্যক্তি সম্পর্কে টীকা দেন নি। অবশ্য সম্পাদনা ও ভূমিকা রচনার যুগ্ম দায়িত্ব তাঁর ছিল না। সুতরাং এদিক থেকে মস্কো সংস্করণের সম্পাদক অনেক ক'টি টীকা দিয়ে একই সঙ্গে সংশোধন ও ব্যাখ্যার কাজে সাহায্য করেছেন।


অন্যদিকে, বইটির পরিশিষ্টয় (রীড-এর দেওয়া) শেষ অংশটিতে দ্বাদশ পরিচ্ছেদের শেষে একটি টাকা পেঙ্গুইন সংস্করণে পাওয়া যায় (পৃ ৩৫১ টা-৭১), মাস্কার ১৯৭৭ ও ১৯৮৭-র বাংলা ও ইংরিজি সংস্করণে সেটি গরহাজির।


মতাদর্শর দিক দিয়ে টেলর সায়েব অবশ্য অন্য মেরুর লোক। রুশ বিপ্লব, লেনিন, মার্কসবাদ ইত্যাদি কোনো বিষয়েই তাঁর মনোভাব অনুকূল ছিল না। জন রীত-এর কৃতিত্ব সম্পর্কেও তার মন্তব্য বেশ গোলমেলে। একবার তিনি বলেন রীড-এর রচনা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ – যা তিনি দেখেছিলেন ও তার অভিজ্ঞতায় এসেছিল। পরমুহূর্তেই তিনি বলেন – বইটির অনেকখানিই কিন্তু হোটেলের ঘরে শান্তিতে বসে দ্য ম্যাসেস  পত্রিকার জন্যে টাইপরাইটারে লেখা (পৃ. আট-নয়)। নানা লোকের কথার টুকরো আর কী-ঘটে-থাকতে-পারে তার কল্পনা মিশিয়ে লেখা হয়েছিল দুনিয়া কাপানো দশ দিন। যেটি নাকি আবার টেলর-এর মতে ‘বহুকাল ধরেই একটি রাজনৈতিক ক্লাসিক’ (পৃ. সাত)। অথচ রীড-এর বইটি পড়লে দেখা যায় – তিনি চরকির মতো ঘুরছেন এখান থেকে ওখানে; বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তর তিনি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।


এখানেই না-থেমে টেলর আরও বলেছেন – ১৯২৭-এ বিপ্লবের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রবাদপ্রসিদ্ধ রুশ চলচ্চিত্র-পরিচালক, সের্গেই আইজেনস্টাইন (১৮৯৮-১৯৪৮)-কে একটি ফিল্‌ম্ তুলতে বলা হয়েছিল। সেটির নাম তিনিই দিয়েছিলেন দুনিয়া কাপানো দশ দিন। টেলর-এর মতে, পুরো চিত্রনাট্যর জন্যে ব্যবহার করা হয়েছিল রীড-এর বইটি; সমকালীন কোনো নিউজ রিল বা ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হেঁটে ফিল্‌ম্‌টি তোলা হয় নি। রীড-এর বইটিকেই তর্জমা করা হয়েছিল চলচ্চিত্রর নিরিখে। তার অনেকটাই কল্পকথা (ফিকশন), রীড-এর বই-এর অনেকটাও সেই রকমই (পৃ. নয়)। মন্তব্যটি রীড ও আইজেনস্টাইন দুজনের পক্ষেই মানহানিকর। উল্‌টে বলা যায়, অক্টোবর  চলচ্চিত্রে এমন অনেক কিছু ছিল যা রীড-এর বই-এ নেই। চলচ্চিত্রর রুপ নাম শুধু অক্টোবর, পরে নতুন সম্পাদনা করে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রর বাইরে ছবিটি মুক্তি পায় দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন নামে। ১০৪ মিনিটের এই নির্বাক ছবিটি প্রথম দেখানো হয় ২০ জানুয়ারি ১৯২৮-এ। ফিল্‌ম্‌টি একা আইজেনস্টাইন করেন নি, যুগ্ম চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ছিলেন গ্রিগোরিও আলেক্‌সান্দ্রোভ। অনেক পরে ফিল্‌ম্‌টির (১৯৬৬) সঙ্গীত যোগ করেন দিমিত্রি শস্তাকোভিচ। যেমন, ‘দেবতাদের’ নিয়ে একটি চিত্র পরম্পরা (সিকুয়েন্‌স)। মার্কিন দেশে বেশির ভাগ প্রিন্ট-এ এটি বাদ দেওয়া থাকে (ফিল্‌ম্‌ ফর্‌ম্‌ - এসেজ ইন ফিল্‌ম্‌ থিওরি, নিউ ইয়র্ক – মেরিডিআন বুকস, ১৯৫৭, পৃ. ৮২)। মন্তাজ-এর পাশাপাশি টাইপেজ-এর কৌশলটিও আইজেনস্টাইন-কে থিয়েটর থেকে চলচ্চিত্রে আনতে উদ্‌বুদ্ধ করেছিল (ফিলম ফরম, পৃ. ৮-৯)। এই চলচ্চিত্রেই তিনি প্রয়োগ করেছিলেন সাহিত্য থেকে নেওয়া আভ্যন্তর এককোক্তি (ইনার মনোলোগ)। সাহিত্যর চেয়ে তার পরিসর অনেক বড়। জেমস জয়েস-এর সঙ্গে আইজেনস্টাইন-এর একবার দেখা হয়েছিল পারী-তে। প্রায় সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও জয়েস চেয়েছিলেন। পটেমকিন আর অক্টোবর দেখতে (ঐ, পৃ. ১০৪)।



এসব রীড-এর বই থেকে আসে নি। রুশ বিপ্লবের স্বরূপ তুলে ধরার জন্যেই এমন সব উদ্‌ভাবন করতে হয়েছিল আইজেনস্টাইনকে। সমান্তরাল মন্তাজ-এর ফ্রেম-কে বিস্তৃত করে এসেছিল একটি নতুন গুণ যাওয়া হচ্ছিল এক নতুন এলাকায় – উত্তরণ ঘটছিল ক্রিয়া (অ্যাকশন)-র জগৎ থেকে তাৎপর্য-র জগৎ-এ; হয়তো এগুলির মধ্যে ভুলও ছিল, কিন্তু তার জন্যে আইজেনস্টাইন-এর মহত্ত্বে কোনো দাগ পড়ে না (ফিল্‌ম্‌ ফর্‌ম্‌, পৃ. ৫৮ দ্র.)। আসলে, রীড-এর বই আর আইজেনস্টাইন-এর চলচ্চিত্র দুটি আলাদা শিল্পকর্ম। সাময়িক সরকার-এর পতনেই চলচ্চিত্রটি শেষ হয়; রীড-এর বই কিন্তু ২৯ নভেম্বর অবধি ঘটনার বিবরণ দিয়ে চলে।


সাত রিল-এর এই চলচ্চিত্রটি প্রায় পুরোটাই তোলা হয়েছিল লেনিনগ্রাদ-এ। গ্রানাডা টেলিভিশন-এ রীড-এর বইটির আর-একটি চলচ্চিত্র রূপ দেন অরসন ওয়েল্‌স্ (১৯৬৭)। ১৯৮২-তে লাল ঘন্টা  (বিকল্প নাম – দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন) বলে আর একটি ফিল্‌ম্ তুলেছিলেন সের্গেই বন্‌দারচুক, তারও ভিত্তি ছিল রীড-এর বইটি।


এমন সব মন্তব্য কীভাবে নেওয়া উচিত – ব্যাজ (নিন্দে) নাকি স্তুতি? টেলর-এর ভূমিকায় ডানহাতে রীড-কে যে-স্তুতি উপহার দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাঁহাতে সেটি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। অথচ লেনিন ও ক্রুপস্কায়া দুজনেই কিন্তু রীড-এর সত্যনিষ্ঠারই প্রশংসা করেছেন। কেতাবি ঐতিহাসিকের চেয়ে এই দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বর অভিমতই বোধহয় বেশি গ্রহণযোগ্য।


রীড-এর বইটিকে ‘অনেকটাই গপ্পো’ বলে নস্যাৎ করার পরেও টেলর তাঁর ভূমিকার শেষে লেখেন—লেনিন ও ক্রুপস্কায়ার একই সুরে—যে বলশেভিক বিপ্লবের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বইটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী (পৃ. উনিশ)! এমন প্রশংসার কারণ একটাই – স্তালিন-এর আমলে রীড-এর বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু ত্রৎস্কি তার নায়ক। টেলর-এর মতে, স্তালিন-এর মৃত্যুর পর থেকে বইটি কমিউনিস্টরা দায়সারাভাবে সয়ে আসছেন, তার বেশি কিছু নয়। টেলর একথা লিখছেন ১৯৭৭-এ, অথচ তার দশ বছর আগেই, নভেম্বর বিপ্লব-এর সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে বাঙলা সমেত একাধিক ভাষায় রীড-এর বইটির অনুবাদ হয়ে গেছে প্রগতি প্রকাশন, মস্কো থেকেই। এখনও পর্যন্ত বইটির তর্জমা হয়েছে পৃথিবীর বহু ভাষায় (ঠিক কটি তা বলার মতো তথ্য হাতে নেই)। ব্যাবসার কথা মাথায় রেখেই পেঙ্গুইন বু্‌ক্‌স্ থেকে ১৯৬৬-তে বইটির একটি সংস্করণ বেরয়। তখনও তার কপিরাইট ছিল লরেন্‌স্‌ অ্যান্ড উইশার্ট-এর। টেলর-এর ভূমিকার নানা মন্তব্য সম্পর্কে তারা আপত্তি তোলে। পেঙ্গুইন বুক্‌স্ তখন কোনো ভূমিকা ছাড়াই বইটি বার করে দেয়—এমনই মুনাফার গরজ। কপিরাইট-এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ট্রেলর-এর ভূমিকা সমেত আবার বেরয় পেঙ্গুইন ক্লাসিক্‌স্ থেকে।


রীড শুধু প্রথম সারির কবিই (মার্কিন কূটনীতিবিদ্‌ ও ঐতিহাসিক অর্থ কেনান-এর ভাষায়) ছিলেন না। টেলর নিজেও বলেছেন – রীড প্রথম সারির গদ্যশিল্পীও বটে (পৃ. আট)। এইটুকু বলাই কিন্তু যথেষ্ট নয়। রীড-এর ছিল অসাধারণ পর্যবেক্ষণ-শক্তি, সূক্ষ্ম রসবোধ আর আপাত অসার ঘটনাবলির ভেতর থেকে সারবস্তুটি বার করে আনার ক্ষমতা। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক –


“কার্লাইল তাঁর ‘ফরাসী বিপ্লব’ পুস্তকে বলেছেন যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতায় বিশ্বে ফরাসীদের জুড়ি নেই। রাশিয়া কিন্তু এ রীতিটি অভ্যাস করে নিয়েছিল ... রাশিয়ার শীতকালে পেত্রগ্রাদের তুহিন শাদা জমাট রাস্তার ওপর সারাদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্বল্পবসন মানুষ!” (পৃ. 8৪)

এই দুরবস্থা সত্ত্বেও রীড লক্ষ্য করেন –

“থিয়েটারগুলো অবশ্য চলছিল প্রতি রাত্রেই, রবিবারও বাদ যেত না। মারিনস্কি থিয়েটারে নতুন একটি ব্যালেতে নামলেন কার্সাভিনা, নৃত্যামোদী গোটা রাশিয়া ছুটল তাঁকে দেখতে। শালিয়াপিন গান গাইছিলেন। আলেক্সান্দ্রিনস্কি থিয়েটারে আলেক্সেই তলস্তয়ের ‘করাল ইভানের মৃত্যু’ নাটক নতুন করে শুরু হয়েছে মেইয়েরহোলদের প্রযোজনায়। (পৃ. ৪৫)”


এই যে খুঁটিনাটির ওপর নজর, কোন্‌ ঘটনার পাল্‌টা হিসেবে কোন্‌ ঘটনা বেছে নিতে হয় এ ব্যাপারে রীড-এর কৃতিত্ব বারেবারেই ধরা পড়ে। আর বিপরীতভাবের ঘটনার সঙ্গে রীড জুড়ে দেন অন্য একটি ঘটনা –

“মনে আছে এ অভিনয়ে বাদশাহী পেজ কোর-এর একটি ছাত্রকে দেখেছিলাম, পরনে তার ড্রেস ইউনিফোর্ম, প্রতিটি অঙ্কের শেষে সে কেতামাফিক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল বাদশাহী বক্স আসনটির উদ্দেশে, যদিও সে আসন তখন শূন্য, তার ঈগল প্রতীকগুলিও সব নিশ্চিহ্ন ... (পৃ. ৪৫। ব্যাঁকা হরফ যোগ করা হয়েছে।)”

শেষের এই বাক্যাংশটি নিছক একটি ঘটনা থাকে না; হয়ে ওঠে প্রতীক।

উইলিয়ম ওয়ার্নিং-এর কথা উদ্ধৃত করে রীড লিখেছেন –

“রুশ শ্রমিক শ্রেণীর অধিকাংশই লিখতে পড়তে জানে। বহু বছর ধরে দেশটা এমনই এক বিক্ষুব্ধ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায় যে রুশ মজুরেরা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যকার বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের নেতৃত্বই লাভ করে নি, সমান বিপ্লবী শিক্ষিত শ্রেণীর বৃহৎ একটা অংশ রাশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক নব-জাগৃতির ধ্যান ধারণা নিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর দিকে ফেরে ... (পৃ. ১৬)”


কথাটি যে রুশ সৈনিকদের ক্ষেত্রেও সত্যি তা বোঝা যায় একটি রণক্ষেত্রর ঘটনায়। রীড লিখছেন –


“রিগার পেছনে দ্বাদশ আর্মির ফ্রন্টে গিয়েছিলাম আমরা, মরীয়া সব ট্রেঞ্চের কাদার মধ্যে হাড় খোঁচা খালিপা লোকগুলোর দুর্দশার একশেষ। কিন্তু আমাদের দেখেই লাফিয়ে উঠল তারা। শিটিয়ে আসা মুখ, ছেঁড়া পোশাকের তল থেকে নীল হয়ে উঠেছে গায়ের মাংস, উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলে – পড়বার কিছু এনেছ? ”(পৃ. ৪৮)


নভেম্বর বিপ্লব যে অনিবার্য ছিল, হঠাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার এটি নয়, তার প্রস্তুতিও ছিল যথেষ্ট—তারও প্রমাণ ব্রীড দিয়েছেন –

“অন্যদিকে ছিল প্রলেতারিয়েতের—মজুর, সাধারণ সৈন্য পরিব কৃষকদের নিরাকার অভিপ্রায়। বহু স্থানীয় সোভিয়েতই ইতিমধ্যে বলশেভিক হয়ে উঠেছিল; তাছাড়া ছিল শিল্প শ্রমিকদের সংগঠন...এই কয়মাস ধরে বিপ্লবী আগুনের ওপরতলায় যে গাদ আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে উঠছিল তা ফেটে পড়ল ফুঁসে ওঠা অন্তর্বিদ্রোহের তরঙ্গে। সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেস বসা সম্ভব ছিল কেবল এক স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলনের জোয়ারেই... ” (পৃ. ৬২)


‘স্বতঃস্ফূর্ত’ শব্দটি ঠিকমতো বুঝতে হবে। গণ-আন্দোলনে জোয়ার এল এক মুহূর্তে, কিন্তু তার প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন ধরে। রীড জানিয়েছেন – ‘দিনের পর দিন বলশেভিক বক্তারা ব্যারাকে ব্যারাকে কারখানায় কারখানায় “গৃহযুদ্ধের এই সরকারকে” ধিক্কার দিয়ে অভিযান চালাল’ (পৃ. ৬২)। এমনই এক সভায় কাদা ভেঙে গিয়ে বলশেভিক নেতা লুনাচারস্কি-র বক্তৃতা শুনেছিলেন রীড – ‘পাতলা চেহারা, ছাত্রের মতো দেখতে, মুখখানা শিল্পীর মতো সংবেদনশীল। বলছিলেন কেন ক্ষমতা নিতে হবে সোভিয়েতকে।’ (পৃ. ৬৩)


শুধু মুখের কথা নয়, ছাপা কাগজও হয়ে উঠল বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রধান এক হাতিয়ার –


“হঠাৎ প্রসারিত হয়ে উঠল বলশেভিক সংবাদপত্র। ‘রাবোচি পুত’ এবং ‘সলদাৎ’ (সৈনিক) এই দুটি পার্টি পত্রিকা ছাড়াও কৃষকদের জন্য নতুন একটি কাগজ ‘দেরেভেনস্কায়া বেদ্‌নোতা’ (গাঁয়ের গরিব) দৈনিক প্রকাশিত হতে থাকল ৫,০০,০০০ সংখ্যায়, এবং ১৭ই অক্টোবর বেরুল ‘রাবোচি ই সলদাৎ’।” (পৃ. ৬৩)


যাঁরা মনে করেন রুশ বিপ্লব নেহাতই অল্প লোকের চক্রান্তে ক্ষমতা দখল, দয়া করে তাঁরা পত্রিকার প্রচার সংখ্যাটি নজর করবেন।

‘পেশাদার’ ঐতিহাসিকরা কদাচিৎ এই ধরণের ঘটনার উল্লেখ করেন। 

এবার রীড-এর রসবোধের দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক –

“সামরিক ও সামুদ্রিক ব্যাপারের জনকমিশাররা চলেছেন বিপ্লবী ফ্রন্ট পরিদর্শন করতে, কে জানে সেটা কোথায়। আমরা কি সঙ্গে যেতে পারি? নিশ্চয় নয়। গাড়িখানায় লোক ধরে শুধু পাঁচ জন, দুজন কমিশার, দুজন আর্দালী এবং ড্রাইভার। তাহলেও আমার এক পরিচিত রুশী তার নাম দেওয়া যাক ত্রুসিশকা, বিনা বাক্যে গিয়ে উঠ বসল, কোনো যুক্তিতেই তাকে নামানো গেল না ... ” (পৃ. ২১০)


এর মধ্যে আর মজার কী আছে? আসল মজা শুরু হয় চলতে চলতে। গাড়িতে কেউ একজন খাবারের কথা তুললেন। তিন-চার দিন বাইরে থাকতে হতে পারে ...। দেখা গেল সকলেরই পকেট গড়ের মাঠ। ত্রুসিশকাই খাবার কিনে আনলেন। যথাস্থানে পৌঁছে কমান্ডান্ট-এর কাছে জানা গেল, ‘সব ঠিক আছে কমরেড, সৈন্যদের মেজাজ চমৎকার ... শুধু একটা ব্যাপার, গুলিবারুদ কিছু নেই আমাদের ...।’


তাতে অসুবিধের কিছু নেই। এক কমিশার জানালেন, ‘স্মোলনিতে দু’শ কোটি রাউও আছে। আপনাকে একটা অর্ডার লিখে দিচ্ছি।’

“কিন্তু হায়! কারুর কাছে এক চিলতে কাগজ নেই, পেনসিলও না। ‘ত্রুসিশকাকে তার নোটবইটা দিতে হল। ... বলাই বাহুল্য এ জনতার মধ্যে একমাত্র পেনসিলটি ছিল ত্রুসিশকার কাছেই ...’ (পৃ. ২১০-২১১)


অন্য উদাহরণটি আরও চমৎকার। মস্কোয় অনেক কষ্টে ন্যাশনাল হোটেল-এ ঠাঁই জুটেছে রীড-এর। এবার খাওয়ার ব্যবস্থা। ‘খাবার খেলাম এক নিরামিষ রেস্তোরাঁ-তে; খুবই হাতছানি দেওয়া তার নাম – “আমি কাউকে খাই না!” দেয়ালে [লিও] তলস্তয়ের ছবি।’ (পৃ. ২৭৫)


রীড-এর তারিফ করে ক্রুপস্কায়া বলেছিলেন রাশিয়ার ভাষা বা রীতিনীতি কিছুই না জেনেও রীড এই বইটি লিখতে পেরেছিলেন, তার কারণ তিনি উদাসীন দর্শক মাত্র নন, মনেপ্রাণে তিনি এমন একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট, যিনি ঘটনাগুলোর মানেটা, মহা সংগ্রামের মানেটা বোঝেন। এই বোধ থেকেই এসেছে তাঁর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যা ছাড়া এমন বই লেখা অসম্ভব হত।’ (পৃ. ৯)


ক্রুপস্কায়া যদি রীড-এর রুশভাষায় অজ্ঞতার কথা না জানাতেন তাহলে হয়তো পাঠক সে-কথা বুঝতেনই না। প্রতিটি রুশ পত্রিকা, ইস্তাহার, পুস্তিকা ইত্যাদি অজস্র উল্লেখ থেকে বরং মনে হয় – রুশভাষায় রীড-এর রীতিমতো দখল ছিল। ঘটনা অবশ্য তা নয়; ক্রুপস্কায়া ঠিকই বলছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে – রুশ না-জানলেও ফরাসি ও জার্মান রীড ভালোই বুঝতেন। আর এই দুটি-ভাষা-জানা লোক শিক্ষিত রুশ সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন সহজেই পাওয়া যেত। তেমন কয়েকজনের কথা রীড-এর বইতেই আছে (পৃ. ২৫০, ২৫৫, ২৬৫, ২৭১)।


Figure 1রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

একই সঙ্গে কৌতুক আর সুগভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটে নিচের এই বিবরণে –

“ঠিক ১০টা ৩৫ মিনিটে কামেনেড ঘোষণার পক্ষপাতীদের কার্ড তুলতে বললেন। বিরুদ্ধে হাত তোলার সাহস করেছিল একজন, কিন্তু চারপাশে প্রচণ্ড হৈচৈ হতেই চট করে সে হাত নামিয়ে নেয় ... সর্ববাদী সম্মত। হঠাৎ যেন এক যৌথ স্বতঃচেতনায় দেখা গেল সবাই আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি, একসঙ্গে গলা মেলাচ্ছি ‘আন্তর্জাতিক’ সঙ্গীতের মসৃণ দোলায়িত ঐকতানে। ... আর এ গান শেষ হবার পর একটা সচকিত স্তব্ধতায় যখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তখন হলের পেছন থেকে কে যেন হাঁক দিলে, ‘কমরেড, মুক্তির জন্যে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মরণ করি আসুন!’ শুরু হল সেই অন্ত্যেষ্টি মার্চ—সেই ধীর, বিষণ্ণ তবু জয়জয়ন্তী এক স্তোত্র, একেবারে রুশী, অথচ কী মর্মস্পর্শী। ‘আন্তর্জাতিকের’ সুরটা যতই হোক বিদেশী, কিন্তু অন্ত্যেষ্টি মার্চটা যে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন নরপিণ্ডের একেবারে প্রাণের কথা যাদের প্রতিনিধিরা আজ এই সভাকক্ষে বসে তাদের আবছা দিব্যদৃষ্টি দিয়ে গড়ে তুলছে এক নতুন রাশিয়া এবং হয়ত আরো কিছু।”(পৃ. ১৬২)



ব্রীড-এর বিবরণে কোনো শস্তা উচ্ছ্বাস নেই। বিপ্লবের পথ যে ফুল-বিছনো ছিল না, বরং কাঁটা ছড়িয়ে ছিল প্রতি পদে—তার নমুনা বইটিতে বারবার পাওয়া যায়। বলশেভিক পার্টির ভেতরে ও বাইরে ক্রমশ সংঘাত চলেছে; ৭ নভেম্বরের আগে ও পরে সর্বক্ষণ চলেছে তর্ক-বিতর্ক। এই সবকিছুর মধ্যে অটল রয়েছেন নিকোলাই লেনিন। ৩ নভেম্বর বলশেভিক নেতাদের ঐতিহাসিক বৈঠকে লেনিন বললেন—সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে—


“৬ই নভেম্বর খুবই আগে হয়ে যাবে ... অন্যদিকে ৮ই নভেম্বর খুবই দেরি হয়ে যাবে ... আমাদের ঘা মারতে হবে ৭ তারিখেই, যেদিন কংগ্রেস শুরু হবে, যাতে কংগ্রেসকে আমরা বলতে পারি ‘এই রইল ক্ষমতা! বলুন কী করবেন?’” (পৃ. ৮৯)


স্বতঃস্ফুর্ততা নয়, সংগঠন; আকস্মিক প্রেরণা নয়, সুচিন্তিত পরিকল্পনা—এই ছিল নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যর মূল উৎস। লেনিন যখন এই বক্তৃতা দিচ্ছেন তখনই ঐ বাড়ির ওপরের তলায় একটি ঘরে বসে আছেন ‘লম্বা চুল একটি লোক, রোগা রোগা মুখ—এককালে ছিলেন জার সৈন্যবাহিনীর অফিসার, পরে বিপ্লবী এবং নির্বাসিত, কোন এক ওভ্‌সেয়েঙ্কো, ওরফে আন্তোনভ, গণিতবিদ্‌, দাবাড়ে; রাজধানী দখলের নিখুঁত পরিকল্পনা ছকছেন তিনি।’ (পৃ ৮১)


শুধু সাহিত্যকর্ম হিসেবে যদি বইটির বিচার করা হয় তাহলেও দেখা যাবে –  দু-চার কথায় বিপ্লবের কুশীলবদের—কী সামনের আর কী পেছনের সারির—এমন নিখুঁত বর্ণনা পেশাদার লেখকরাও এত স্বচ্ছন্দে দিতে পারেন না। সবার ওপরে অবশ্য দেখা দেন লেনিন। রীড-এর বর্ণনা –

“বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মস্ত এক টেকো ঢিপকপালী মাথা কাঁধের ওপর শক্ত করে বসানো। ছোটো ছোটো চোখ, বোঁচাটে নাক, চওড়া উদার মুখ, ভারি চিবুক; মুখটা তখন কামানো, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর অতীত ও ভবিষ্যতের সেই সুপরিচিত দাড়ি খোঁচা খোঁচা গজিয়ে উঠেছে। পরনে জীর্ণ পোষাক, ট্রাউজার জোড়া বেমানান লম্বা। জনতার প্রিয়পাত্র হবার দিক থেকে একেবারেই দাগ কাটার মতো চেহারা নয়, অথচ যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি পেয়ে গেছেন তা বোধ হয় ইতিহাসের খুব কম নায়কের ভাগ্যেই জুটেছে। অদ্ভুত একজন নেতা—যিনি নেতৃত্ব করছেন একান্তই তাঁর মেধার জোরে; অরঙ্গীন, অরসিক, অটল, অনাসক্ত, এমনকি চমকপ্রদ কোনো পাগলামিও যাঁর কিছু নেই, কিন্তু আছে গভীরতম ভাবনাকে সহজে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা, নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নিখুঁত বিশ্লেষণের শক্তি। বিচক্ষণতার সঙ্গে মিলনে যা এক মেধাশক্তির মহত্তম স্পর্ধা।” (পৃ. ১৫৫-৫৬)


এর চেয়ে সঠিকভাবে লেনিন-এর পরিচয়, লেনিন কীসে লেনিন, দেওয়া বোধহয় সম্ভব নয়। জৌলুস নেই, নাটুকেপনা নেই, আছে শুধু মেধার জোর—এমন জননেতা লেনিন-এর আগে সত্যিই পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়নি।


‘নভেম্বর বিপ্লব – জন রীড-এর চোখে’ লেখাটি ‘কোরক: নভেম্বর বিপ্লব : শতবর্ষে ফিরে দেখা (শারদ ২০১৭)’ থেকে সংগ্রহীত। 

ডিরোজিও ও বাঙলায় যুক্তিবাদের প্রসার -
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:885 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যুক্তিবাদ বলতে দর্শনের ছাত্রছাত্রীরা প্রথমেই মনে করেন সতেরো শতকের ইওরোপে প্রত্যক্ষবাদ (এম্পিরিসিজম) বনাম যুক্তিবাদ (র‍্যাশনালিজম)-এর কথা। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ থেকেই র‍্যাশনালিজম  শব্দটি অন্য এক অর্থে ব্যবহার হতে শুরু করে। সেটি হল: মতামত বা কাজকর্মর ব্যাপারে ধর্মবিশ্বাস বা আবেগের ওপর ভরসা না করে যুক্তি ও জ্ঞানের ভিত্তিতে আচার-আচরণ ও নীতি ঠিক করা। এর জন্য খুব বড় অভিধান দেখার দরকার নেই; কনসাইজ অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি, দ্বাদশ সংস্করণ, ২০১১ দেখলেই চলবে।


হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ছিলেন এই ধরণের যুক্তিবাদী। ভগবান আছেন না নেই এই নিয়ে তিনি কোনো নির্দিষ্ট মত দিতেন না, প্রচার করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু তাঁকে নাস্তিক বলে দাগা মেরে হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ডিরোজিও কিন্তু তাঁর ছাত্রদের একটা কথাই বলতেন: কোনো বিষয়ে মত স্থির করার আগে তার পক্ষে ও বিপক্ষে যত যুক্তি আছে সেগুলো জেনে বুঝে বিচার করে তবে নিজের মত ঠিক করবে। এই শিক্ষাই ডিরোজিওর স্বল্পায়ু জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি। কারুর কথা শুনে বা আবেগের বশে কোনো মতের প্রতি পক্ষপাত দেখানো উচিত নয়; বরং নিজের বোধবুদ্ধির ওপর ভরসা রেখে পক্ষে-বিপক্ষে যা বলার আছে সেগুলো নিক্তিতে ওজন করে ঠিক করো: কার পাল্লা ভারী। ছাত্রদের তাই যে কোনো বিষয়ে বিতর্ক করতে উৎসাহ দিতেন তিনি। নিজেরা মাথা খাটিয়ে, দরকার মতো পড়াশুনো করে তারা যেন ঠিক-ভুল পরখ করতে শেখে।


উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ডিরোজিওর ছাত্ররা দেখা দিয়েছিলেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতবিদ্য ও কৃতী মানুষ হিসেবে। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ সিকদার, রামগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ — এঁদের নাম বাঙলার ইতিহাসে, বিশেষত শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সদাস্মরণীয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এঁদের কয়েকজনের নাম অক্ষয় হয়ে আছে। বাড়ির মেয়েদের পড়ার জন্য মাসিক পত্রিকা বের করা কম গৌরবের বিষয় নয়। তার সম্পাদক ছিলেন রাধানাথ সিকদার ও প্যারীচাঁদ মিত্র। বাঙলা সাহিত্যিক গদ্যর বিকাশে তাঁদের অবদান এখনও বোধহয় ঠিকমতো বোঝা হয়নি। টেকচাঁদি ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে বিদ্যাসাগরি আর হুতোমি ভাষার ঠিক মাঝখানে। উঁচু আর নিচু রীতির মধ্যে মাঝারি রীতি। একেও বলা যেতে পারে ডিরোজিওর পরোক্ষ প্রভাব।


হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮১৭)-র আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে বোঝাত: একজন সায়েব (বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান)-এর কাছে কাজ চালানোর মতো ইংরিজি শেখা। অন্য কিছু স্কুলে (বাঙালি-পরিচালিত) একই ধরণের ইংরিজি শিক্ষা হতো: ছড়া কেটে ইংরিজি শব্দ ও তার বাঙলা প্রতিশব্দ মুখস্থ করানো। তার পরেও, আরও উঁচু ক্লাসে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের কিছু তথ্য মনের মধ্যে গেদে দেওয়া হতো।

ফরাসি লেখক আনাতোল ফ্রাঁস চেয়েছিলেন: আমাদের শিক্ষণ ভরা হোক ভাবনায়। এতকাল এটি শুধু তথ্য দিয়ে ঠাসা হয়েছে’ (Let our teaching be full of ideas. Hitherto it has been stuffed only with facts)। অবশ্যই এ এক নতুন শিক্ষাদর্শ। এখনও পর্যন্ত বাস্তবে তার নমুনা চোখে পড়ে না। কোনো কোনো মনীষী এর জন্যে নিজেরাই আলাদা আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও বারট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel)-এর কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির ভেতরে থেকে, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও ডিরোজিও চেয়েছিলেন কিশোর ছাত্রদের মনে অন্ধবিশ্বাসের জায়গায় পক্ষপাতহীন যুক্তিবুদ্ধির বীজ রোপণ করতে। তার জন্য তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছিল। কুৎসা রটনা ছাড়াও তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। হিন্দু কলেজের পরিচালকরা রীতিমতো কোমর বেঁধে, প্যাঁচ কষে ডিরোজিওকে তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে সরালেন।


এর থেকে একটা জিনিস বোঝার আছে: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র আর যুক্তিবুদ্ধির সহাবস্থান অসম্ভব। মুক্তচিন্তা আর পাঠক্রম মেনে পরীক্ষা-কেন্দ্রিক শিক্ষা ও তার ফল – দুটো একযোগে চলে না। ডিরোজিও-ও সে কথা বুঝতেন। তাই হিন্দু কলেজের বাইরে, নিজের বাড়িতে ও মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহ-র বাগানবাড়ির ঘরে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গড়ে মুক্ত চিন্তা বিকাশের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। রেভারেন্ড লালবিহারী দে লিখেছেন: ‘The young lions of the Academy roared out, week after week, “Down with Hinduism! Down with orthodoxy!’’’


হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালি সমাজে তথ্যর পাশাপাশি ভাবনাচিন্তার একটা জায়গা হলো। যত সঙ্কীর্ণই হোক তার সীমা, বাঙালি সমাজের ওপরের স্তরে তার থেকেই একটা কাঁপন ধরল। তার উদ্যোক্তা সব ক্ষেত্রেই ডিরোজিয়ান বা ইয়ং বেঙ্গলরা নন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন বেশ কিছু মানুষ, তাঁদের সকলেই অবশ্য ইংরিজি শিক্ষিত, ঢাকঢোল না-পিটিয়েই, শাঁখ-ঘণ্টা না বাজিয়েই একটি একটি করে প্রথাবিরোধী কাজ শুরু করলেন। এগুলোর সাথে ডিরোজিও কেন, কোনো ডিরোজিয়ানেরও সাক্ষাৎ যোগ ছিল না। তবু কলকাতা ও মফস্বলে যুক্তিবুদ্ধির প্রসার এইভাবেই হয়েছে। এঁরাও ডিরোজিওর–ই সন্ততি।


রামমোহন রায় যখন সতীদাহ-র বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম পুস্তিকাটি লিখলেন (১৮১৮) সেখানেও বিষয়টি উপস্থিত করা হয়েছিল তর্ক-র আকারে: প্রবর্তক (যিনি সতীদাহ চান) আর নিবর্তক (যিনি তা বন্ধ করতে চান) এমন দুজন কাল্পনিক ব্যক্তির ‘সম্বাদ’ বা ডায়ালগ (ঠিকমতো বললে: ডুওলোগ) হিসাবে। এখানেও সেই দুটি পরস্পর-বিরোধী মতের দ্বন্দ্ব। রামমোহন নিজে কোনো সিদ্ধান্ত দেন নি, সে-বরাত পাঠকের ওপরে।


বাঙলা তথা ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনাটিও চিরস্মরণীয়। তক্কাতক্কি তো ভারতের লোকে বহুকাল ধরেই করে আসছেন। কিন্তু সে হলো শখের তক্ক। তার মীমাংসার ওপর জগৎ-জীবনের কিছুই নির্ভর করে না। অমর্ত্য সেন যাদের ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ (আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান) বলেছেন, তাদের সঙ্গে রামমোহনের সময় থেকে যে সব তক্কাতক্কি শুরু হলো, তার তফাত অনেক। সতীদাহ থাকবে না বন্ধ হবে, বিধবার আবার বিয়ে দেওয়া যাবে, না যাবে না; একজন লোকের অনেক বউ থাকা উচিত না অনুচিত — এই ধরণের বিষয়ে তক্কাতক্কির একটা ব্যাবহারিক গুরুত্ব আছে। এগুলো শুধুই ‘সুখপাঠ্য লাঠালাঠি’ নয়, এগুলোর মীমাংসার ওপরে মেয়েদের — সব জাতের, সব অবস্থার মেয়েদের — বাঁচা-মরা জড়িয়ে আছে।


দুঃখের বিষয়, রামমোহন রায়ের সঙ্গে ডিরোজিওর পরিচয় হয়নি। অনেক বছরই তাঁরা এক শহরে বাস করেছেন। কিন্তু ফিরিঙ্গি সমাজ আর বাঙালি সমাজের মধ্যে তেমন যোগ ছিল না, বরং বিয়োগই ছিল বলা যায়। বোধহয় সেই কারণেই ডিরোজিওর শিক্ষক ড্রামন্ড বা তাঁর কোনো ছাত্রের সঙ্গে রামমোহন রায়ের পরিচয় হয় নি।


সতীদাহ বন্ধ করার আইন, ১৮২৯-এর ১৭ নং রেগুলেশন জারি হলো। রামমোহন অবশ্যই তাতে খুবই খুশি হয়েছিলেন। তাঁর সমর্থনে খুব অল্প লোকই ছিলেন, এগিয়ে এসেছিলেন আরও কম লোক। গণভোট নিলে সতীদাহ সমর্থকরাই বিপুল ভোটে জয়ী হতেন। (বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রেও কথাটি সমানভাবে সত্যি; প্রগতিশীলরাই এখানে সংখ্যালঘু, রক্ষণশীলরাই সংখ্যাগুরু)। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি জায়গা থেকে সতীদাহ বন্ধ করার সমর্থন এসেছিল। ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল (ডিসেম্বর ১৮২৯)-এ একটি কবিতা বেরোল; ‘অন দ্য অ্যাবলিশন অব সতী’। কবির নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। পত্রিকার সম্পাদক লিখেছিলেন; ‘বিষয়টি কবিরই যোগ্য; আর কবি দেখিয়েছেন যে তিনিও এই বিষয়ে (কবিতা রচনায়) অনুপযুক্ত নন।’


সমাজ সংস্কারের মতো চিন্তাসংস্কারও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বাঙলায় পরবর্তীকালে যাঁরা সেই কাজে হাত দিয়েছেন তাঁদের সবাই ডিরোজিওর কাছে — আর তার সঙ্গে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের কাছেও — প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণী। ডিরোজিওর সাক্ষাৎ ছাত্ররা তাঁর যুক্তিবাদের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যান নি। দিলীপকুমার বিশ্বাস দেখিয়েছেন একজন ডিরোজিয়ানও ‘উত্তর জীবনে নাস্তিকতা প্রচার করেন নি।’ কথাটি ঠিক। ডিরোজিয়ান তথা ইয়ং বেঙ্গল-এর মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহেশচন্দ্র ঘোষ খ্রিস্টান হয়েছিলেন, হরচন্দ্র ঘোষ নিষ্ঠাবান হিন্দু-ই থেকে যান, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, চন্দ্রশেখর দেব, শিবচন্দ্র দেব ব্রাহ্ম হন, প্যারীচাঁদ মিত্র ব্রহ্মবিদ্যা বা থিওজফি আন্দোলনে যোগ দেন, আর রসিককৃষ্ণ মল্লিক এক সর্বজনীন ধর্ম-য় বিশ্বাস করতেন।


বরং নাস্তিকতার ধারাটি প্রচার হয়েছিল অক্ষয়কুমার দত্ত মারফত। ধ্রুববাদী (পজিটিভিস্ট) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকলেই নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। বিশেষ করে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যর নাম করা যায়। এঁরা কেউই সরাসরি ডিরোজিও-প্রভাবিত ছিলেন না। তবু বাঙলায় যুক্তিবাদী আন্দোলনের হাতেখড়ি হয়েছিল ডিরোজিওর কাছে — এই সত্যটি অস্বীকার করা যাবে না। বাঙলা সাহিত্যে ধ্রুববাদী আন্দোলনের দিকচিহ্ন ধরা আছে রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ-য়। জ্যাঠামশায় এক আশ্চর্য চরিত্র। ইতিহাসের ধারায় দেখলে তিনিও কিন্তু ডিরোজিও-রই উত্তরসূরি।


আর একটি কথা বলে আলোচনা শেষ করি। ডিরোজিওকে লোকে চেনেন অ-সাধারণ শিক্ষক আর কবি বলে। এখানে তুলনায় কম পরিচিত একটি কবিতা উদ্ধৃত করা হলো:

ক্রীতদাসের মুক্তি

গোলামির পালা শেষ। কি এক বিচিত্র অনুভূতি!

মুক্তি পেয়ে সমুদ্বেল বুক ভরে গর্বের স্পন্দনে

সহসা ভাস্বর হল অন্তরের মহৎ প্রস্তুতি

নতজানু-দাসত্বের ক্রান্তির ঘোষণা সেই ক্ষণে:

নিজেকে চিনেছে দাস মানুষের আত্মার সম্মানে,

আকাশে তাকিয়ে নেয় নন্দনের বাতাসে জীবন,

বুনোপাখিদের ঝাঁক উড়ে যায়, দেখে ঊর্ধ্বপানে,

মৃদু হাসি মুখে মেখে নিজেকেই জানায় বন্দন!

ওদিকেতে চেয়ে দেখে কলস্বরে ঝর্ণা চলে নেচে,

বাতাস — পাখিরা — ঝর্ণা দেখে ভাবে কি খানিক

“আমিও ওদের মতো মুক্ত হয়ে রয়েছি ত বেঁচে!”

সহসা চেঁচিয়ে ওঠে অতঃপর ভুলে দিগ্বিদিক।

মুক্তি! নাম থেকে ঝরে সুনিবিড় মাধুর্য তোমার,

হৃদয়ের বেদীতটে জ্বেলেছ যে শিখা অনির্বাণ,

স্বদেশের মুক্তিযজ্ঞে উদ্ভাসিত খোলা তলোয়ার

শোণিতের পুণ্য-অর্ঘ্যে এনেছ কি মুক্তির সম্মান!

ধন্য হোক সেই হাত যে-হাত করেছে খান খান

শোষণের শিকলকে; ধন্য হোক সে-আত্মপ্রসাদ

নিপীড়িত মানবাত্মা যার বলে হল বলীয়ান

ক্রীতদাস পেল যাতে অবশেষে মুক্তির আস্বাদ।

ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭

অনুবাদ : পল্লব সেনগুপ্ত

(ডিরোজিও: সময়ের এ্যালবাম, শক্তি সাধন মুখোপাধ্যায় ও অধীর কুমার সংকলিত, ডিরোজিও স্মরণ সমিতি, পাত্র’জ পাবলিকেশন, ২০০৩)

ডিরোজিওর অন্য একটি পরিচয় আড়ালেই থেকে যায়। তিনি যে সাংবাদিকও ছিলেন, অনেককটি পত্রপত্রিকার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগ ছিল — এই কথাটি খেয়াল করা হয় না। অথচ বাঙলা তথা ভারতে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ডিরোজিও-র নাম রেডিয়ামের অক্ষরে লিখে রাখার কথা। কটি কাগজের তিনি সহ-সম্পাদক বা সম্পাদক ছিলেন সে নিয়ে বিতর্ক আছে। এমনকি দ ক্যালাইডোস্কোপ, যে মাসিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘আমার ছাত্রদের প্রতি’ (টু মাই পিউপিলস) কবিতাটি বেরিয়েছিল, তাতেও স্বাক্ষর ছিল: এইচ সি।


হিন্দু কলেজের ছাত্রদের জন্য সনেট


ফুলের তরুণ কলি যেভাবে ছড়ায় পাপড়ি তার

সেইমতো দেখি মৃদু খুলে যায় তোমাদের মন,

আর কী মধুর খোলে সেই সব সম্মোহন ভার

বেঁধে রেখেছিল যারা তোমাদের সমর্থ মনন,

যে মনন করে দেয় তার সব ডানা প্রসারণ

(গ্রীষ্মের প্রহরে যেমন পাখির শাবক) উড়বার

শক্তির পরখ করে। অভিঘাত কত না হাওয়ার,

প্রথম জ্ঞানের কত বৈশাখের নবীন বর্ষণ।

অগণ্য নতুন কত বোধ — সবই চিহ্ন রেখে যায়

তোমরা নিরত থাকো সর্বশক্তি সত্যের পূজায়।

কত যে আনন্দধারা আমার উপরে পড়ে ঝুরে

যখন তাকিয়ে দেখি যশোদেবী ভবিষ্যমুকুরে

গেঁথে চলেছেন মালা কখনও যা পাবে তোমরা, তাই

সে-সময়ে মনে হয় এ জীবনে বাঁচিনি বৃথাই।


অনুবাদ : শঙ্খ ঘোষ

(ভারত-বীণা ও অন্যান্য সনেট-কবিতা, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রোগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০২)


কোনো কোনো শিক্ষককে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা পদ্যর কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়, কিন্তু ছাত্রদের উদ্দেশে শিক্ষকের লেখা কবিতা — তায় আবার এমন চমৎকার কবিতা — বিরল। কবিতাটি যে ডিরোজিওর — তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তারও কোনো প্রমাণ নেই। হারিয়ে যাওয়া পত্রিকাটি আগাগোড়া ছেপে বার করেন প্রয়াত অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকার যে নীতি-বিষয়ক বিবৃতি, তার সঙ্গে ডিরোজিও-র নিজের মতামতের কোনো মিল নেই। সুরেশচন্দ্র মৈত্র তাই সঙ্গত কারণেই আপত্তি তুলেছেন ডিরোজিও আদৌ ঐ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কিনা।


কিন্তু ডিরোজিও যে দ ইস্ট ইন্ডিয়ান নামক পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই পত্রিকায় অনেক বকধার্মিকের মুখোশ খুলে দেওয়া হতো। যেমন, অগাস্ট ১৮৩১-এ ভাদ্রোৎসব উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে পণ্ডিত বিদায়-এর ব্যবস্থা হয়েছিল। দুশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও তাঁদের ছেলেদের দু’টাকা থেকে ষোল টাকা হারে দক্ষিণা দেওয়া হয় (১৮৫ বছর আগে টাকার অঙ্কটা তুচ্ছ নয়)। দ ইস্ট ইন্ডিয়ান-এ লেখা হয়েছিল: ‘ব্রাহ্মসভা কি ব্রাহ্মণদের ভেলকিবাজির মঞ্চ? আমরা তো জানতাম, তা নয়। কারণ এই সভার প্রতিষ্ঠাতা হলেন রামমোহন রায়। তিনি মানবপ্রেমের পূজারী, ঈশ্বরোপাসনাকে শুদ্ধতম নীতির উপর স্থাপন করেছিলেন।’ তারপর পণ্ডিত বিদায়-এর খবরটি দিয়ে ঐ পত্রিকায় লেখা হয়: ‘শুনতে পেলাম সমাজের পরিচালকেরা এমন কাজ নাকি হামেশাই করে থাকেন। দয়াধর্ম প্রশংসনীয় কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা: একই সময়ে কাউকে উঁচুতে তোলা আর নিচুতে নামানোর কী অর্থ আছে? আসলে এ হল সম্পূর্ণ আজগুবি কাণ্ড!’


ঐ পত্রিকাতেই হিন্দুসমাজকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল: রক্ষণশীল, আধা উদারপন্থী আর উদারপন্থী।


শুধু সাংবাদিকতা নয়, কথায় ও কাজের মিল না থাকলে তার সমালোচনা করাও ছিল দ ইস্ট ইন্ডিয়ান-এর অন্যতম কাজ। তার সম্পাদক সমীপেষু অংশে এমন চিঠি ছাপা হতো। বড়লোকের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় বড়লাট, ছোটোলাট থেকে প্রধান বিশপ ও অন্যান্য খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের উপস্থিতি নিয়ে এমন একটি চিঠি ছাপা হয়েছিল। সাংবাদিকতার এই ঐতিহ্য, ডিরোজিওকে বিশিষ্ট ও স্মরণীয় করে রেখেছে।

বিদ্যাসাগর: একালের নিরিখে -
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:877 | likes:0 | share: 0 | comments:0

লেখক প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শন বিশেষত চার্বাক/লোকায়ত দর্শন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট তাত্ত্বিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

বড় মাপের মানুষদের সম্পর্কে অনেক গল্প চালু হয়। সেগুলোর সবই যে পুরো ঠিক তা নয়। কিন্তু কোনো-কোনোটির মধ্যে অন্তত কিছুটা সত্য থাকে। মা-য়ের ডাকে সাড়া দিতে বিদ্যাসাগর ঘোর বর্ষায় সাঁতরে দামোদর পেরিয়েছিলেন— এই গল্পটি পুরোপুরি বানানো। এর মধ্যে এক তিলও সত্য নেই, যদিও হাজার হাজার, হয়তো লক্ষ লক্ষ লোক আজও গল্পটি বিশ্বাস করেন। কিন্তু সে কথা থাক। মানুষের বিশ্বাস করার ক্ষমতা অসীম— যত অসম্ভব ততই যেন বিশ্বাস্য। আরও কম-জানা কিন্তু বিশ্বাস্য একটি গল্প দিয়ে শুরু করি।

উনিশ শতকের শেষে বাঙলায় হিন্দু ধর্মকে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। তার নেতা ছিলেন শশধর তর্কচূড়ামণি (১৮৫২-১৯২৮)। তিনি থাকতেন কাশীতে; প্রচারের জন্যে তাঁকে কলকাতায় আনা হয়েছিল। তিনি একবার গেছিলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে৷ বিদ্যাসাগর তাঁকে বলেন,

‘আপনাকে হিন্দু ধর্ম প্রচারের জন্য যাঁরা এনেছেন তাঁরা যে কেমন দরের হিন্দু তা তো আমি বেশই জানি, তবে আপনি এসেছেন, বক্তৃতা করুন। লোকে বলবে, বেশ বলেন ভালো। এমন একটা প্রশংসালাভ করবেন এইমাত্র।’ এর পরে তিনি যোগ করেন, ‘আমার স্কুলের [মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন-এর] ছেলেরা যে মুরগির মাংস খায়, আপনার বক্তৃতায় তাঁরা যে সে মাংস ছাড়বে আমি তা একেবারেই বিশ্বাস করি না।’

কথাগুলি শশধরও লিখে যাননি, বিদ্যাসাগরও না। একজন তৃতীয় ব্যক্তি, শশিভূষণ বসু ঘটনাটি লিখেছেন (‘বিদ্যাসাগর-স্মৃতি’, প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৪৩, পৃ.৫৪৯)। অবশেষে তাঁর মন্তব্য: ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় অতি উদারচেতা পুরুষ ছিলেন, ধর্ম্ম-বিষয়ে তাঁহার কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তবে আমার বিশ্বাস প্রচলিত হিন্দু ধর্ম্মের অনেক উচ্চে তিনি বাস করিতেন।’ তাঁর মতে, ‘লোকের ধর্ম্ম-বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা বড় কঠিন বিষয়। তাই এখানে এ-বিষয়ে আর কিছু বলিলাম না।’

একালে মানুষের পরিচয় রাজনৈতিক বিশ্বাস দিয়ে। বিদ্যাসাগরের সময়ে অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হয়নি। গণতন্ত্র শব্দটিও চালু ছিল না। তাঁর জীবন কেটেছে খানিকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে (১৮২০-১৮৫৮), বাকিটা মহারানি ভিকটোরিয়ার অধীনে (১৮৫৮-১৮৯১)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৮৫-তে৷ বিদ্যাসাগরের তাতে কোনো উৎসাহ ছিল না। এবিষয়ে তাঁর কোনো লিখিত মতামত পাওয়া যায় না। তবে নানা লোকের কথায় জানা যায়: বক্তৃতা করে ভারত উদ্ধারে তাঁর আস্থা ছিল না। একজন অন্তত বলেছেন, বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধুদের বলতেন: ‘তোমাদের আর উপায় নেই। জঙ্গলে গিয়ে পল্টন তৈরী করো।’ তিনি সময়ে সময়ে এত গরম ভাবে কথা বলতেন যে, বন্ধুরা তাঁর ঘরের কপাট বন্ধ করে দিতেন। বাঙলার অন্যতম প্রথম বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে একথা জানিয়েছিলেন মেদেনীপুরের একটি স্কুলের একজন অতি বৃদ্ধ পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই মানসিক প্রস্তুতির দ্বারাই এই অতিবৃদ্ধ পণ্ডিত আমাদের কর্মে [অর্থাৎ, বিপ্লবী কাজকর্মে] সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াছিলেন’ (ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম, নবভারত পাবলিশার্স ল, ১৯৮৩, পৃ. ৯৩)।

তার মানে, সরাসরি কোনো ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগ না থাকলেও, তাঁর একটি রাজনৈতিক মত ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল।

তবে এও ঘটনা যে, নিজের ধর্মবিশ্বাসের মতো রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়েও তিনি কারুর সঙ্গে আলোচনায় যেতেন না। তাঁর সমসময়ের সকলেই অবশ্য জানতেন: তিনি পরকালে বিশ্বাস করেন না, বরং সেই নিয়ে ঠাট্টা করেন (বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, বিদ্যাভারতী, ১৩৭৩ ব., পৃ.১৩১)।

ডিরোজিও আর ইয়াং বেঙ্গলের মারফত একই সঙ্গে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা আর যুক্তির যুগ-এর ধারণা এসেছিল বাঙলায়। বিদ্যাসাগরও তাঁর নিজস্ব রীতিতে আধুনিক পৃথিবীর সেইসব ধারণাকেই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন। এই দিকটিকে জোর দেওয়া হয় না, অথচ এর ওপরেই তাঁর গোটা জীবন-দর্শন দাঁড়িয়ে আছে। দীনেশচন্দ্র সেনকে একটি চিঠিতে (১৭ নভেম্বর ১৯০৫) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘… বোলপুরের বিদ্যালয় স্থাপন ও শিক্ষার ভার নিজের হাতে ও স্বদেশী ভাবে প্রবর্ত্তনের চেষ্টা’ ছিল স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইনি বলেন, ‘এ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় অগ্রণী। তিনি ইংরেজি ধরণের বিদ্যালয় দেশীয় লোকের দ্বারা চালাইতে সুরু করেন— আমার চেষ্টা যাহাতে বিদ্যাশিক্ষার আদর্শ যথাসম্ভব স্বদেশী রকম হয়।’ (চিঠিপত্র, খণ্ড ১০, বিশ্বভারতী, ১৩৭৪, পৃ.৩৩)।

বিদ্যাসাগরের চরিত্রর অনেক দিকই দুর্জ্ঞেয়, শুধু সাধারণ লোকের পক্ষেই নয়, সকলের পক্ষেই। সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে বইটির উপসংহার-এ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি বাক্য ছিল। কেন তিনি দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে সেটি বাদ দিলেন, তা সহজ বুদ্ধিতে বোঝা যায় না। তেমনি, বোধোদয়-এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ঈশ্বর ও ঈশ্বরসৃষ্ট পদার্থ’ অংশটি থাকলেও (সম্ভবত) পঞ্চম সংস্করণ থেকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ বাদ দিলেন, আবার ১০৫তম সংস্করণে কেনই বা প্রথমে ‘পদার্থ’ ও তার পরে ‘ঈশ্বর’ নামে দুটি আলাদা অংশ আনলেন— সে রহস্যও ভেদ করা যায় না।

বিদ্যাসাগরের স্বরূপ বোঝার পক্ষে তাঁর জীবনীকাররাও দুটি বড় বাধার সৃষ্টি করেন। এক তো হলো তাঁর মননশীলতার চেয়ে হৃদয়বত্তার ওপর বেশি জোর দেওয়া, আর দ্বিতীয় হলো জনদরদে তাঁকেও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। বিদ্যাসাগর কেন ১৮৫৯-এর সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলেন নি এই নিয়ে কোনো কোনো গবেষক কমবেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷ অলডস হাক্সলি দুঃখ করেছিলেন যে ভারতে ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হচ্ছে কিন্তু জনশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। মুসোলিনির কারাগারে বন্দী, বিশিষ্ট মার্কসবাদী তত্ত্ববিদ, আন্তোনিও গ্রামশি (১৮৯১-১৯৩৭) বলেছিলেন, কথাগুলোর মধ্যে কিছুটা সত্য আছে। কিন্তু দেশের ‘প্রথাগত বুদ্ধিজীবী’দের নিয়ে আগে উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত না করলে নিচের স্তরের ছেলেমেয়েদের শেখাবেন কারা? আর গোড়ার দিকের শিক্ষার সুযোগ তাই সকলে পাবেন না, বরং অল্প লোকই পাবেন (Antonio Gramsci, Selections from the Prison Notebooks, New York: International Publishers, 1971, pp.26-43; Further Selections from the Prison Notebooks, Minneapolis: University Minnesota Press, 1995, p.122)।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930